দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি বা অবসাদ

বিকেল অতিক্রান্ত হলেই কোথায় চলে যায় আপনার শক্তি?  প্রত্যেক দিনই কি শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার একই অনুভূতি হয় আপনার? আপনি কি লক্ষ্য করেছেন শিশুরা আপনার চারপাশে কি সুন্দর ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে, আর আপনি বসে আছেন নিজেকে শূন্য করে! একেই বলে অবসাদ, অনীহা, ক্লানত্মি, আলস্য কিংবা অবসন্নতা। 
প্রতিবছর কয়েক লাখ লোক ডাক্তারের কাছে যান শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর জানতে কেন তারা কোন কিছুতেই উৎসাহবোধ করেন না? কখনও কখনও তাদের ক্লানত্মি বা অবসাদের একটা স্পষ্ট কারণ থাকে যেমন রক্তস্বল্পতা, বিষণ্নতা, থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা, ঘুমের সমস্যা কিংবা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া। আবার কখনও মারাত্মক কোন শারীরিক সমস্যার কারণে দীর্ঘস্থায়ী ক্লানত্মি বা অবসাদবোধ হতে পারে। যদি আপনি দীর্ঘদিন ক্লানত্মি বোধ করেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
তবে অনেক গোপন কারণেও দীর্ঘস্থায়ী ক্লানত্মিবোধ হতে পারে, যার সাধারণত সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বর্তমান লেখাটিতে বেশ কিছু উপায়ের কথা উলেস্নখ করা হলো, যা মেনে চললে দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি বা অবসাদ কাটিয়ে উঠে তরতাজা থাকা সম্ভব।
 

নড়াচড়া করুনঃ
অনেকের এটা মনে হতে পারে যে আমরা যদি শারীরিক পরিশ্রম না করি তাহলে অনেক বেশি শক্তি অনুভব করব। কারণ শারীরিক পরিশ্রম না করলে শক্তি বাঁচবে। সত্যিই কি তাই? তাহলে কেন আমরা সাধারণত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের পরে পূর্ণ শক্তি অনুভব করি? এর কারণ হলো শরীরের মাংসপেশী ও হৃদ-রক্তনালীতন্ত্র একটি গাড়ির ইঞ্জিনের মতো। নিয়মিত চলাচল ইঞ্জিনের কার্যকারিতা এবং অশ্বশক্তিকে বৃদ্ধি করে। একইভাবে আপনি যখন কাজ করবেন, তখন আপনি স্বসত্মি অনুভব করবেন। যে সব ব্যক্তি শারীরিকভাবে সুস্থ তারা দৈনিক সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করে এবং জিনিসপত্র বহন করে দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারেন।
ব্যায়াম হলো মানসিক চাপ ও দুশ্চিনত্মা দূর করার এক উত্তম পন্থা। এটা শক্তি বাঁচানোরও একটি উপায়। 


স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সপ্তাহে তিন থেকে চারবার ২০ থেকে ৬০ মিনিট মধ্যমমাত্রা থেকে উচ্চমাত্রার ব্যায়াম করা উচিত। সত্যি কথা বলতে কি, আপনি যদি প্রতিদিন ৩০ মিনিট মধ্যমমাত্রার কাজকর্ম করেন তাহলে বিরাট স্বাস্থ্য সুবিধা লাভ করবেন। বর্তমানে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আপনাকে ৩০ মিনিট স্বল্পমাত্রার কাজ করতে বলছেন, যেমন সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা, অল্প পথ দ্রম্নত হাঁটা, ঘরের কাজকর্ম করা, নাচা, শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করা ইত্যাদি।
 

 একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠুন:
আপনি যদি স্রেফ গৃহবধূও হন তাহলে বিকেল বেলা একটু পায়চারি করম্নন কিংবা আশপাশের মার্কেট থেকে ঘুরে আসুন। এতে আপনার একঘেয়েমি ভাব কেটে যাবে এবং বিকেলটাকে আর ক্লানত্মিকর মনে হবে না।


নিজেকেই প্রশ্ন করুন আপনি কি পছন্দ করেন? বারো মাস ফুলের গাছ লাগানো? টেনিস খেলা? এসব কাজ কিন্তু আপনাকে ক্লান্তির বদলে শক্তি জোগায়।
কিছু কিছু ৰেত্রে অবসাদ বা ক্লান্তির একটি প্রধান কারণ হলো একঘেয়েমি। তাই আপনাকে অবশ্যই একঘেয়েমিজনিত ব্যাপারগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। সপ্তাহে একদিন কোথাও বেড়াতে যান, আড্ডা দিন, কিছু আনন্দকর ব্যায়াম উপভোগ করম্নন, মজাদার কাজকর্ম করম্নন, দেখবেন কেটে গেছে বিরক্তিকর অবসাদ বা ক্লানত্মি।


চমৎকার ঘুম দিনঃ
আপনি যদি রাতে মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টা ঘুমান তাহলে আপনি ক্লানত্মি ও দুর্বল বোধ করবেন। তবে একঘণ্টা এদিক সেদিক হলে সেটা দীর্ঘস্থায়ী ক্লানত্মির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।


 সত্যিকারার্থে অনেকে দিনের পর দিন পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা ঘুমান, যদিও তাদের প্রয়োজন সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম। এক-দু'রাত ঘুম কম হলে খারাপ অনুভব নাও হতে পারে, তবে মনে রাখতে হবে পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন রয়েছে। আপনি যদি ঠিকমতো না ঘুমান তাহলে কোন কাজে মনোসংযোগ দিতে পারবেন না।
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ঘুম সচেতনতা এবং শক্তির মাত্রাকে বৃদ্ধি করে। আপনি দুপুরের পর কিছুৰণ ঘুমিয়ে আপনার ক্লানত্মি কাটিয়ে উঠতে পারেন।


ওষুধের দিকে লক্ষ রাখুনঃ
কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ আপনাকে ক্লান্ত বা অবসাদগ্রস্ত করে তুলতে পারে। এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে এ্যান্টি হিস্টামিন, উচ্চরক্তচাপের ওষুধ ও কাশি নিরোধক ওষুধ। 


তবে অন্য সাধারণ ওষুধগুলোও আপনার মধ্যে দুর্বল ভাব আনতে পারে। অপিয়েটসমৃদ্ধ কিছু এ্যান্টি ডায়রিয়াল ওষুধ এবং এ্যান্টি কলিনার্জিক ওষুধগুলো আপনার মধ্যে ঘুম ঘুম ভাব আনতে পারে। একইভাবে বমি নিরোধক ওষুধগুলো অনেক লোকের মধ্যে ঘুমভাব আনে। কিছু নন স্টেরয়ডাল এ্যান্টি ইনফ্লামেটরি বা প্রদাহবিরোধী ওষুধ (যেমন আইবুপ্রফেন) ঘুমভাব আনতে পারে। সম্ভব হলে বিকল্প ওষুধ যেমন এ্যাসিটামিনোফেন বা এ্যাসপিরিন দিয়ে চেষ্টা করম্নন। এসব ওষুধ সাধারণত ঘুমঘুম ভাব সৃষ্টি করে না।
 

 চাপমুক্ত থাকুন:
বর্তমানে ক্লানত্মি বা অবসাদের এক নম্বর কারণ হলো চাপ। এ চাপ শরীরে অতিরিক্ত এ্যাড্রেনালিন ও অন্যান্য হরমোনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় ও শরীরে শক্তির জোগান বেড়ে যায়। কিন্তু এ অতিরিক্ত শক্তি আপনাকে অবসন্ন করে তোলে।


আপনি সব সময় চাপমুক্ত থাকুন। চাপ আপনার শরীর ও মনকে চুরমার করে দেয়। সুতরাং আপনাকে ক্লানত্মি বা অবসাদমুক্ত থাকতে হলে চাপমুক্ত থাকার কৌশলগুলো শিখতে হবে। আর তার আগে আপনাকে জানতে হবে চাপ আপনার ওপর কী কী প্রভাব ফেলে। আপনার শারীরিক ও মানসিক অবস্থাগুলো পর্যবেক্ষণ করুন আপনি কি আপনার ঘাড়ে টান অনুভব করেন? আপনার কি পেট খারাপ হয়? আপনার কি পিঠ ব্যথা হয়? অথবা আপনি কি উদ্বিগ্ন বোধ করেন? মন খারাপ হয়? রেগে যান? মাথা ঝিমঝিম করে?
যদি একবার আপনি আপনার চাপের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে পারেন তাহলে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়। কিছু শিথিলায়ন পদ্ধতি যেমন গভীরভাবে শ্বাস নেয়া ও যোগ ব্যায়াম আপনার শরীরকে অতিরিক্ত চাপমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। আর যদি আপনার সব সময় নেতিবাচক মনোভাব থাকে তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
 

সঠিকমাত্রার ক্যালরি গ্রহণ করুণঃ
যদি আপনি ডায়েটিং করেন কিংবা খুব কম খান তাহলে আপনার ক্যালরির মাত্রা অনেক কমে যাবে, যার কারণে আপনি ক্লানত্মিবোধ করবেন।

 আপনি যদি ঠিকমতো ক্যালরি গ্রহণ না করেন তাহলে আপনার শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে।
স্বাভাবিক ওজন কমানোর ৰেত্রে আপনি যতটুকু ক্যালরি গ্রহণ করেন, তার চেয়ে ব্যয় করেন বেশি। সে কারণে আপনার শরীর তার সংরৰিত ক্যালরি ৰয় করে অর্থাৎ আপনার জমানো চর্বি। কিন্তু আপনি যদি ক্যালরি গ্রহণ অতিরিক্ত মাত্রায় কমিয়ে দেন, আপনার শরীরের কার্যক্রমও কমতে শুরম্ন করবে। এ পুরো প্রক্রিয়াটি শরীরের জন্য অস্বাভাবিক এবং মারাত্মক চাপের এবং এ কাজের অনেক উপসর্গের মধ্যে একটি হলো ক্লানত্মি বা অবসাদ। সুতরাং অবসাদ এড়াতে ডায়েট করবেন না। দৈনিক এক হাজার ৫শ' ৫০-এর নিচে ক্যালরি গ্রহণ করবেন না। বরং ব্যায়াম করলে শরীরের প্রয়োজনে আরও এক হাজার বেশি ক্যালরি গ্রহণ করম্নন।
ডায়েট আপনাকে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার থেকে বঞ্চিত করে। এটা আপনার জন্য ৰতিকর। কারণ আপনি ঠিকমতো ক্যালরি গ্রহণ করতে পারেন না। আর এ কারণে আপনি হয়ে পড়েন পুষ্টিহীন।
সুতরাং শক্তি না কমিয়ে ওজন কমাতে নিচের নিয়ম মেনে চলুন :


চর্বি কমান : ফ্যাট ক্যালরি প্রোটিন কিংবা কার্বোহাইড্রেট ক্যালরির চেয়ে খুব সহজেই বডিফ্যাটে রূপানত্মরিত হয়।


 এ ছাড়া ফ্যাটে প্রোটিন বা কার্বোহাইড্রেটের চেয়ে বেশি ক্যালরি থাকে। তাই ফ্যাটি ফুড বা চর্বিসমৃদ্ধ খাবারের বদলে উচ্চমাত্রার কার্বোহাইড্রেট খাবার যেমন ফলমূল, শাকসবজি ও খাদ্যশস্য খান। এতে আপনার ক্যালরি হঠাৎ খুব কমে না গিয়ে আপনাকে ওজন কমাতে সাহায্য করবে। আপনি খাদ্য থেকে চর্বি কমান, ক্যালরি নয়।
ধীরে ধীরে ওজন কমান : হঠাৎ করে ওজন কমাবেন না। ধীরে ধীরে কমান। 


সপ্তাহে আধা কেজি। এর বেশি কমালে তা আপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। হঠাৎ ওজন কমে গেলে আপনার ক্লানত্মি বা অবসাদ ও পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, আপনার হার্টের সমস্যাও হতে পারে।
 

ডা. মিজানুর রহমান

Comments

Popular posts from this blog

কালোজিরার গুণ

জোড়ার বাত ও প্রতিকার

ব্রন থেকে মুক্তি পাওয়ার ১০০% পরীক্ষিত উপায়